দারিদ্র বিমোচনে ক্ষুদ্র ঋণের ভূমিকা গুলো কি জানুন

অর্থনৈতিকভাবে কিভাবে দরিদ্র মানুষগণকে সাবলীল করে গড়ে তুলতে পারে ও তাদের দৈনন্দিন জীবনযাপন এর উন্নতি হয় তা জানতে পারবেন আমাদের এই কারিকুলামে। যত ধরনের ঋণ আছে এই প্রকল্পে ক্ষুদ্র ঋণ তার মধ্যে অন্যতম। দারিদ্র দুরিকরণে এই ঋণের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

অর্থনৈতিক উন্নয়নের পাশাপাশি সমাজ ব্যবস্থা পরিবর্তন করতেও এই ঋণ ব্যবস্থার বিশেষ আলোকপাত রয়েছে। কিভাবে দরিদ্র মানুষের জীবনের মান উন্নয়নে বিশেষ সহায়ক এই ক্ষুদ্র ঋণ প্রকল্প, সেটা বুঝানোর উদ্দেশ্যই হচ্ছে এই আলোচনার মুল বিষয়।

আলোচ্য বিষয়ঃ 

নারীর ক্ষমতায়নে ক্ষুদ্র ঋণের ভূমিকা

আমরা স্বপ্ন দেখি একটি সদেশের যেখানে সফলতার সবকটি সুযোগের জন্য নারী ও মেয়েদের ক্ষমতায়নকে গরুত্ব প্রদান করা হয়েছে। সমতার দিক থেকেও এর গুরুত্ব অগ্রাধিকার করা হয়েছে কিন্তু বেশিরভাগ নারীই বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতার মুখে পড়তে হচ্ছে এই পথে। তারা যা-ই করার উদ্দ্যোগ নেয় না কেন, সে বিষয়ে সুযোগ প্রদান নিশ্চয়তা করার ক্ষেত্রে ক্ষুদ্র ঋণ বিশেষ ভূমিকা পালন করে। ক্ষদ্র ঋণ তাদের উদ্দ্যেশ্য সফল করার এক বিশেষ মাধ্যম হিসেবে কাজ করে। বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, কমিউনিটি সংগঠন এবং বিভিন্ন জনবলের গুরুত্বপূর্ণ সহায়তার পাশাপাশি এই ক্ষুদ্র ঋণ ব্যবস্থা নারী ও মেয়েদের ক্ষমতায়নে সাহায্য করছে। একজন নারী ঋণ নিতে যে কোন ব্যাংকের ধারের কাছেও যেতে পারবে না সে সকল নারী বিনা জামানত সাপেক্ষে বিভিন্ন এনজিও ও এমএফআই এর মাধ্যমে ঋণ নিয়ে হাঁস মুরগি পালন, খামার ইত্যাদির মাধ্যমে তাদের ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করে আসছে যা সমাজ ব্যবস্থায় বিশেষ বিশেষ ভূমিকা পালন করে।

আর্থ সামাজিক উন্নয়নে ক্ষুদ্র ঋণের ভূমিকা

আমাদের দেশে অর্থনৈতিক উন্নতিতে ক্ষুদ্র ঋণ ব্যবস্থা বিশেষ ভূমিকা পালন করে আসছে। দারিদ্রতা থেকে সচ্ছলতা অর্জন সবচেয়ে বড় বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ। বছরে পর বছর দারিদ্র মানুষের উন্নতিকল্পে রাষ্ট্রপ্রধানগণ ও অর্থনীতিবিদরা বিভিন্ন অবকাঠামো বা কৌশল নিয়ে কাজ করে আসছেন। কিন্তু সকল অবকাঠামো বা কৌশলের মধ্যে এই ক্ষুদ্র ঋণ-ই হচ্ছে সর্বাপেক্ষা সফল উদ্যোগ। ড. মুহাম্মদ ইউনুসের গ্রামীণ ব্যাংক ২০০৬ সালে নোবেল জয়ের মধ্য দিয়ে ক্ষুদ্র ঋণ প্রকল্প সারা বিশ্বব্যাপী সর্বজনীনতার বিষয় স্পষ্ট করে তুলেছেন। দারিদ্রগ্রস্থ জনসাধারণের জন্য ক্ষুদ্র ঋণ ব্যবস্থা অর্থনৈতিক উন্নতিকল্পে সর্বাধিক ভূমিকা পালন করছে। তৃণমুল পর্যায়ে ক্ষুদ্র ঋণ ব্যবস্থা পৌছানোর ফলে দেশের অর্থনৈতিক গতি প্রকৃতি উন্নয়নের ক্ষেত্রে যে ভূমিকা পালন করছে তা প্রকৃত দৃশ্যমান। এই ঋণ ব্যবস্থা শহরের বিভিন্ন বস্তি ও গ্রামের বহু ছোট ছোট উদ্যোক্তাদের সুচনা ঘটায় যা দেশের দারিদ্র বিমোচন কমিয়ে আনার ক্ষেত্রে বিশেষ ভুমিকা রাখে।

আরো পড়ুনঃ প্রাকৃতিক উপায়ে রূপচর্চা যেভাবে করবেন

দারিদ্র বিমোচনে এনজিওর ভূমিকা

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত এনজিও একটি বিশেষ আলোচিত বিষয়। উন্নত দেশগুলোর আর্থসামাজিত প্রেক্ষাপটে দরিদ্রকে পূঁজি করে এই এনজিও ব্যবস্থার বিকাশ ঘটে। তাছাড়া সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো যখন দারিদ্র দুরিকরণে হিমশিম খাচ্ছিলো তখন বিভিন্ন দাতা দেশগুলোর বিনিয়োগের ফলে এনজিও ব্যবস্থার শুরু হয়। আমাদের দেশে দেশি-বিদেশি এনজিও’র সংখ্যা ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে। এনজিও’র বিশেষ ভূমিকাগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য বিষয়গুলো হলো-

কৃষি উন্নয়নঃ 

আমাদের এই দেশ একটি কৃষি প্রধান দেশ। গ্রামের একদল দরিদ্র জনগোষ্ঠি প্রকাশে বা অপ্রকাশে কৃষির উপর নির্ভর করে থাকে। কৃষির মান যত উন্নয়ন হবে, দারিদ্রের হার ততই কমে আসবে। এই ক্ষেত্রে এনজিও তাদের কৃষি ঋণ প্রদান করে থাকে দারিদ্র জনগণকে। ফলে কৃষি উৎপাদন সম্প্রসারণ হয় এবং দারিদ্র লাঘব হয়।

ক্ষুদ্র ও কুঠির শিল্পায়নঃ 

আমাদের দেশের এনজিও সমূহ সহজ শর্তে জনসাধারণকে ক্ষুদ্র ও কুঠির শিল্পে ঋণ দিয়ে আসছে। কুঠির শিল্প উন্নয়নের ফলে দেশে দারিদ্র বিমোচন হচ্ছে এবং গ্রাম উন্নয়ন বৃদ্ধি পাচ্ছে।

মানব সম্পদ উন্নয়নঃ 

মানবিক মান উন্নয়ন, জনগোষ্ঠির মর্যাদা বৃদ্ধি, ব্যক্তিত্ব ও সৃজনশীলতা বিকাশে মানুষের নিজ সক্ষমতার উদ্যোগে নিত্যনতুন আবিস্কারে পদক্ষেপ গ্রহণের উদ্যোগী করে তোলে। অন্ধদৃষ্টি ও কুসংস্কারাচ্ছন্ন জীবনের বিপরীতে সমাজ ও সমস্যাগুলোকে বিশ্লেশনের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক ধারনায় উদ্বুদ্ধকরণ করতে এনজিও সমূহের অবদান অপরিসীম।

কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও আয় বৃদ্ধিঃ 

বেকারত্ব হলো আমাদের দেশে দরিদ্রের মূল কারণ। এনজিও গুলো বিভিন্ন প্রকল্পে ঋণ প্রদানের পাশাপাশি বহুসংখ্যক বেকার জনবলের কর্মসংস্থানে বিশেষ ভূমিকা পালন করে। এর আওতায় সেচ প্রকল্প, পুকুর ও খালে মাছ চাষ, উপকূলে মাছ আহরণ, তাঁত শিল্পে, ভূমিহী চাষীর কৃষি সামগ্রী বিতরণ ইত্যাদি প্রকল্পে এনজিও’র ঋণ বিশেষ সুবিধা দিয়ে আসছে। নারী-পুরুষের যৌথ সমন্নয়ে, গবাদি পশুপালন, হাঁস মুরগির টিকা প্রদান ও চিকিৎসা প্রদান, নার্সারী খাতে, শিক্ষা ও ঋণ দান করে দারিদ্র দুরিকরণে বিশেষ গুরুত্ব অবদান পালন করছে।

দারিদ্র বিমোচনে গ্রামীণ ব্যাংকের ভূমিকা

ক্ষুদ্র ঋণ দারিদ্রতা দুরিকরণের যেমন ভূমিকা পালন করে ঠিক তেমনই দারিদ্র দুর করতে গ্রামীণ ব্যাংক বিশেষ অবদান পালন করে থাকে। আমাদের দেশে বৃহৎ একদল মানুষ গ্রামে বসবাস করে এবং এর মধ্যে বেশিরভাগই দারিদ্রের পরিমান বেশি। কিছু সময় পূর্বে কোভিড-১৯ ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে বহু জনগণ ক্ষুদা, দারিদ্রতা, নিরক্ষরতা ও বেকারত্বের সাথে লড়াই করে আসছে। আমাদের দেশের সরকারের বিভিন্ন অর্থায়ন কর্মসূচির মধ্যে গ্রামীণ ব্যাংক অর্থায়নও একটি। এই গ্রামীণ ব্যাংক কর্মসূচী বর্তমানে বেকারত্ব দুরিকরণে বিশেষ ভূমিকা পালন করে আসছে।

আরো পড়ুনঃ সাত দিনে মোটা হওয়ার উপায় সম্পর্কে জানুন

কৃষি উৎপাদনে ক্ষুদ্র ঋণের ভূমিকা

কৃষিখাত বাংলাদেশে জীবিকা নির্বাহের প্রধান খাত হিসেবে বিবেচিত করা হয়। তাই কৃষিখাতের বিভিন্ন উপকরণ হিসেবে ক্ষুদ্র ঋণ বিশেষ মাত্রার ভূমিকা পালন করে যা দেশের খাদ্য নিরাপত্তার উন্নতি তথা অর্থনৈতিক উন্নয়নে কৃষিখাত এবং গ্রাম অঞ্চলের গুরুত্ব সমুন্নত করার লক্ষ্যে ব্যাংক ও এনজিও প্রতিষ্ঠানগুলোর মাধ্যমে কৃষি ও পল্লী ঋণ ব্যবস্থা কর্মসূচী অব্যাহত রয়েছে। বর্তমানে কৃষি ঋণ কর্মসূচী আরও গতিশীল রাখতে বেসরকারি ও বিদেশী ব্যাংকসমূহ তথা তফসিলি ব্যাংককে কৃষি ঋণ এর আওতায় অন্তর্ভূক্ত করা হয়েছে। ২০০৯-১০ অর্থবছর হতে ২০১৩-১৪ অর্থবছরের কৃষি ঋণ বিতরণে সহজ পদ্ধতি ও নিত্যনতুন কৌশল এবং কর্মসূচীর আওতায় “কৃষি ও পল্লী ঋণ” নীতিমালা সংযুক্ত করা হয়েছে। এই নীতিমালা অনুসারে, কৃষি ও পল্লী ঋণের ক্ষেত্র বৃদ্ধি, গ্রাম এলাকায় ব্যাংকিং সেবা সম্প্রসারণ নীতিমালা গ্রহন, কৃষকদের ব্যাংক অভিমূখী তথা আর্থিক সেবার আওতায় আনয়ন, আমদানির পরিবর্তে ফসলী চাষের উৎসাহ বৃদ্ধি প্রদান, মৎস্য ও প্রাণিজ সম্পদ উন্নয়নে গুরুত্ব প্রদান, কম্পোস্ট সার উৎপাদন সহ বিভিন্ন বিষয়সমুহে ক্ষুদ্র ঋণ প্রকল্প কাজ করে আসছে। আশা করা যায় ক্ষুদ্র ঋণ প্রকল্প কৃষি উৎপাদনে সহায়তার পাশাপাশি কৃষকদের অর্থ প্রবাহ সম্প্রসারণ, দারিদ্র দুরিকরণ েএবং গ্রাম অঞ্চলের সর্বসাধারণের মান উন্নয়নে বিশেষ ভূমিকা পালন করবে।

দারিদ্র বিমোচনে ব্র্যাকের ভূমিকা

আপনারা দারিদ্র দুরিকরণে ব্র্যাকের ভূমিকা সম্পর্কে জানতে চান তাদের বলি, সেই ১৯৭২ সাল থেকে আজ অবধি ব্র্যাক আর্থ ও সামাজিক উন্নয়নকল্পে বিশেষ ভূমিকা রেখে চলেছে। ৫টি সামাজিক এন্টারপ্রাইজ, ১৬টি উন্নয়ন কর্মসূচির মাধ্যমে ব্র্যাক দেশব্যাপী দারিদ্র দুরিকরণ, খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চয়তা, স্বাস্থ্যসেবা, জেন্ডার সমতা, উন্নত শিক্ষা ব্যবস্থা সহ গুরুত্বপূর্ণ খাতে অবদান পালন করে আসছে।

ক্ষুদ্র ঋণের সুবিধা

সাধরণত যারা ব্যাংকিং সেবা থেকে বঞ্চিত তাদের জন্য ক্ষুদ্র ঋণ একটি বিশেষ অর্থায়নের যোগান হিসেবে ভূমিকা পালন করে থাকে। ক্ষুদ্র ঋণের ফলে উদ্ভাবন হয় নতুন নতুন উদ্যোক্তার, যার ফলে যেমন দারিদ্র দুরিকরণ হয় তেমন দেশের আর্থিক সুচোক বৃদ্ধিতে বিশেষ সহায়ক অবদান রাখে। সহজ শর্তের করনে আমাদের দেশের জনগণ সহজেই ক্ষুদ্র ঋণ প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে ঋণ সুবিধা গ্রহণ করে থাকে।

শেষকথাঃ 

প্রিয় পাঠকগণ, যারা আমাদের দেশে দারিদ্র জনগোষ্ঠী তাদের জন্যই মূলত এই লেখা। যারা মূলত বেকার ও অর্থনৈতিক সমস্যায় ভুগছেন তারা আমাদের এই লেখা পড়ে নিশ্চয় আংশিক লাভবান হবেন। ছোট করে বলতে গেলে আমাদের দেশের বেশিরভাগ মানুষ দারিদ্র বিধায়, দেশে অবস্থিত বিভিন্ন ক্ষুদ্র ঋণদান প্রতিষ্ঠান থেকে সহজ শর্তে ঋণ সুবিধা গ্রহণ করতে পারেন এবং উদ্যোক্তা হতে পারেন। ফলে একদিকে যেমন দারিদ্রতাও কমবে, পক্ষান্তরে দেশের উন্নয়ন খাতে বিশেষ ভূমিকা পালন করে এই ক্ষুদ্র ঋণ ব্যবস্থা।

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url