কবুতর পালন ও পদ্ধতি

শখের পাশাপাশি কবুতর পালন খুবই লাভজনক ব্যবসাও বটে। শহর-গ্রাম সর্বত্র সারা বছরই কবুতরের চাহিদা থাকে। অল্প পুঁজিতে কবুতর পালন ভালো হয়। অন্য যে কোন পেশা বা কাজের পাশাপাশি কাজ করে যে কেউ আয় করতে পারে। একজন গৃহিণী তার সংসারের সব কাজ কিন্তু কবুতর পালন করেন। কবুতর পালন করে নারী-পুরুষ উভয়েই স্বাধীন হতে পারে। কবুতর বছরে কয়েকবার ডিম পাড়ে, বাচ্চা হয়। তাই বলা হয়, বক-বাকুম পায়রা, বারো মাসে তেরো জোড়া।

আলোচ্য বিষয়ঃ 

কবুতরের বৈশিষ্ট্য এবং জাত বৈশিষ্ট্য

পায়রা খুব শান্ত পাখি। এই পাখি শান্তির প্রতীক হিসেবে পরিচিত। সারা বিশ্বে কবুতর অত্যন্ত মূল্যবান। এটা বিশ্বাস করা হয় যে পাখিদের মধ্যে, পাখিটি প্রথম মানুষ দ্বারা গৃহপালিত হয়েছিল। পায়রাও বুদ্ধিমান পাখি মানুষ কবুতরকে অনেক কাজে দিয়েছে। কবুতর খুব দ্রুত উড়তে পারে। লালী কবুতর একটি বন্য জাত। তারা সাধারণত গাছ বা পরিত্যক্ত ভবনে থাকতে পছন্দ করে। অন্যান্য জাতের কবুতর গরু পালন করা হয়। তারা দলবদ্ধভাবে থাকতে পছন্দ করে।

আরো পড়ুনঃ  ফ্রিল্যান্সিং একাউন্টিং কি এবং একাউন্টিং ফ্রিল্যান্সিং কিভাবে শিখবো

কবুতর পালন ও পরিচর্যা

কবুতর পালন খুব একটা কঠিন বিষয় নয়। কবুতর রাখার জন্য, প্রথমে আপনাকে এর বসবাসের ব্যবস্থা ঠিক করতে হবে। বাজারে খাঁচা কিনতে পাওয়া যায়। কিন্তু খাঁচা বানাতে চাইলে ওয়েন্ডিং দোকানে গেলে লোহা দিয়ে খাঁচা বানাতে পারবেন। বাশের খাঁচা বানাতে হলে যারা বাশের কাজ করে তাদের দিয়েই বানাতে হবে। ছুতারের সাহায্যে টিন ও কাঠ দিয়েও কবুতরের খাঁচা তৈরি করা যায়। এক জোড়া কবুতরের জন্য একটি খাঁচা নীচে একটি ট্রে সহ দৈর্ঘ্য ২০ ইঞ্চি এবং প্রস্থ ২০ ইঞ্চি হতে হবে। ট্রেটি এমন হতে হবে যাতে ট্রেটি বের করে সহজেই পরিষ্কার করা যায়। আশেপাশের বাজারে কবুতর কেনা যায়। তাই কবুতর কিনতে কোন সমস্যা নেই। নতুন কেনা কবুতরকে কয়েকদিন খাঁচায় বন্দি করে রাখতে হবে। সীমাবদ্ধ না থাকলে কবুতর তার আগের ঠিকানায় চলে যেতে পারে। সে জন্য নতুন কেনা কবুতরের পায়ে সুতো বেঁধে রাখা ভালো। ফলে হারিয়ে গেলে কবুতরে বাধা সুতো দেখে সেটি খুঁজে পাওয়া সহজ হয়।

আরো পড়ুনঃ  বিক্রয় পরিকল্পনার অর্থ কী এবং কীভাবে বিক্রয় বাড়ানো যায় তা জানুন

করুতরের খাবার

কবুতর সাধারণত শস্য খায়। যেমন: গম, ধান, চাল, সরিষা, ভুট্টা ইত্যাদি ছাড়াও ভিটামিন সমৃদ্ধ শস্যদানা বাজারে পাওয়া যায় একটি কবুতরকে দিনে ৫০ গ্রাম শস্য খাওয়ানো উচিত। প্রতিদিন খাঁচায় একটি পাত্রে দিনে ৩ বার পানি দিতে হবে। খাওয়ার পর পানির পাত্রটি বের করে নিতে হবে। কবুতর ডিম দিলে খাবারের পরিমান বাড়িয়ে দিতে হবে। এইমতাবস্থায় প্রতিদিন ৭৫ গ্রাম খাবার দেওয়া উচিত কেননা এসময় তাদের খুদা বৃদ্ধি পায়। তাছাড়া তারা বাচ্চাদের ঠোকে করে কাবার খাওয়ায়।

কবুতরের বাচ্চা উৎপাদন

এক জোড়া কবুতর প্রতি মাসে দুটি করে ডিম পাড়ে। কবুতর মিলনের সময় একটি পায়রা এবং একটি পায়রি সাবধানে পরীক্ষা করার পর নিতে হবে। অনেক বার অসাধু ব্যবসায়ীরা পায়রাকে পায়রি ও পায়রিকে পায়রা বানাতে চায়। কবুতর চার থেকে পাঁচ মাস বয়সে ডিম দেওয়া শুরু করে। কবুতরের কথা ডাকলেই বুঝবে ডিম পাড়ার সময়। এ সময় খাঁচার ভেতরে ডিম পাড়ার জন্য একটি মাটির পাত্র যেমন প্লেট বা বাটি রাখতে হবে। মাটির পাত্রের ভিতর পুরনো চাট বা খড়ের টুকরো ছড়িয়ে দিতে হবে ভালো করে ডিমে দিতে পারেন।

এক জোড়া কবুতর দুই দিনে দুটি ডিম পাড়ে এবং বাচ্চা ফোটে। দেওয়ার সময় খেয়াল রাখতে হবে যাতে খাঁচা নড়তে না পারে। বিশেষ করে খাবার পরিবেশনের সময় এই বিষয়ে খেয়াল রাখা উচিত। ডিমে যে কবুতরগুলো দিয়েছে সেগুলোকে ধরা ও স্পর্শ না করাই ভালো। ডিম পাড়ার ১৮ থেকে ২১ দিন পর ডিম ফুটে। শিশুর জন্মের পর খাঁচায় খাবারের পরিমাণ বাড়াতে হবে। বাচ্চাদের আলাদা করে খাওয়াতে হবে না। মা কবুতর নিজেই বাচ্চাদের খাওয়ায়।

ডিম ফোটার এক সপ্তাহ পর পুরনো চাট বা খড় নতুন পাত্রে রেখে বাচ্চাকে একই জায়গায় বসাতে হবে। পুরানো পাত্রটি সরিয়ে ফেলতে হবে। পাত্রটি পরিষ্কার করে স্টোরেজে রাখতে হবে। জন্মের ২১ দিন পর কবুতরের বাচ্চা নিজে থেকে খাবার খেতে পারে। ২১ দিন পর, বাচ্চাদের আলাদা ঘরে বা খাঁচায় রাখতে হবে।

কবুতরের রোগ ও চিকিৎসা

সাধারণত কবুতরের তেমন বেশি রোগ হয় না। তবে রানিক্ষেত, কলেরা, রক্ত পায়খানা, বসন্ত ও নিয়োমোনিয়া জাতীয় সংক্রামক রোগ কখনো কখনো দেখা দেয়। তাছাড়া পরজীবী যেমন কৃমি, উকুন বা আটালি করুতরকে আক্রান্ত করতে পারে।

রানিক্ষেত:
রানিক্ষেত গৃহপালিত পাখির একটি মারাত্মক সংক্রামক রোগ। এই রোগটি একটি ভাইরাস দ্বারা সৃষ্ট। মূলত এটি মুরগির জন্য খুবই মারাত্মক একটি রোগ। কবুতরও এ রোগে আক্রান্ত হয়। এই রোগে আক্রান্ত হলে ৭০% বা তার বেশি পাখি মারা যায়। লক্ষণসমূহ
১. প্রাথমিক পর্যায়ে, কবুতরের তীব্র তাপমাত্রা থাকবে।
২. খাওয়া বন্ধ বা কমিয়ে দেবে।
৩. পায়রা ঝিমাতে থাকবে।
৪. চুনের মত সাদা পায়খানা করবে।
৫. আক্রান্ত কবুতর দুই থেকে তিন দিনের মধ্যে মারা যাবে।

প্রতিকার:
সাধারণত ভাইরাল রোগের জন্য কোন চিকিৎসা কার্যকর হয় না। তবে সময়মতো টিকা দিলে এ রোগ প্রতিরোধ করা যায়।

কবুতরের টিকা:
কবুতরের বয়স ৭ দিন হওয়ার সাথে সাথে তাদের উভয় চোখে দুটি ফোঁটা দিতে হবে টিকা দিতে হবে। ২১ দিন পর আবার দুই চোখে দুই ফোঁটা ভ্যাকসিন দিতে হবে। BCRDB কবুতরের বাচ্চাদের রানিক্ষেত রোগের ভ্যাকসিন। এই সব ভ্যাকসিন পশু হাসপাতালে পাওয়া যায়। এর রং সবুজ। ৫ সিসি জলে ফুটিয়ে ঠান্ডা করুন সেই সবুজ ওষুধ ব্যবহার করতে হবে। স্বাভাবিক অবস্থায় ওষুধ প্রস্তুত করা ৪ ঘন্টার মধ্যে ব্যবহার করতে হবে। কিন্তু ফ্রিজে রেখে ৩ থেকে ৪ দিন ব্যবহার করা যায়। RDV হল বড় কবুতরের রোগের টিকা। এর রং সাদা। ফুটিয়ে ঠান্ডা করুন প্রতিটি বুতরের জন্য ১০০ সিসি গরম পানি নিয়ে বোতলের ভিতরে ওষুধটি দ্রবীভূত করে পায়ের মাংসে ১ সিসি ইনজেকশন দিতে হবে। কবুতরের বয়স ৬০-৭০ হলে প্রথম টিকা দেওয়ার দিন এবং ছয় মাস পর পুনরায় টিকা দিতে হবে। কবুতরের খামার ব্যবস্থাপনা

আকার:
৩০-৪০ জোড়া কবুতর একটি খামারের জন্য আদর্শ ঘরের আকার ৯ ফুট ১৮.৫ ফুট হবে। এক জোড়া কবুতরের জন্য ২-৩ তলা ঘর তৈরি করা যায়। কবুতরের ২টি বাসা দরকার যাতে ১টি কবুতর একটি নীড়ে ডিম দেয়, অন্য খোপের মধ্যে আরেকটি কবুতর থাকতে পারে এতে ডিম পাড়া সুবিধাজনক। এই ধরনের খোপে ছোট পায়রা প্রতি জোড়া ৩০ ৮৩০ ১২০ সে. মি. এবং বড় কবুতরের জন্য ৫০ ৮৫৫ ১:৩০ সে.মি.।

উচ্চতা:
মাটি থেকে খোপের উচ্চতা ২০-৩৬ ফুট, তবে ২৪ ফুট করলে ভালো হয় এবং খাঁচার উচ্চতা ৮-১০ ফুট হতে হবে।

স্বাস্থ্যসম্মত খামার ব্যবস্থাপনা

খামার থেকে আর্থিক লাভের জন্য স্বাস্থ্যকর খামার ব্যবস্থাপনা বা ফার্ম বায়োসিকিউরিটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ অধিকাংশ রোগই খামার ব্যবস্থাপনার সাথে সম্পর্কিত। সুস্থ খামার ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা এতে একদিকে যেমন বিভিন্ন রোগ থেকে রক্ষা পাওয়া যায় মানসম্পন্ন বাচ্চা উৎপাদন হবে এবং অধিক লাভজনক হবে। সুস্থ খামার পরিচালনার মূল বিষয়গুলি নীচে তালিকাভুক্ত করা হয়েছে:
১. শেডটি সঠিকভাবে তৈরি করতে হবে যাতে পর্যাপ্ত আলো-বাতাস থাকে ও বাতাস চলাচল করতে পারে
২. উপরে উল্লিখিত পদ্ধতিতে, সঠিক আকারের বাসা তৈরি করতে হবে।
৩. কবুতর তোলার পূর্বে খামার সহ ব্যবহৃত সকল যন্ত্রপাতি ঠিকমত জীবাণুমুক্ত করা আবশ্যক।
৪. সুস্থ কবুতর সংগ্রহ করতে হবে। প্রয়োজনে বাহ্যিক কৃমিনাশক এর জন্য কবুতরকে ০.৫% ম্যালাথিয়ন দ্রবণে গোসল করাতে হবে। সেক্ষেত্রে এই দ্রবণে কবুতরের মুখ ডুবানো যাবে না। অভ্যন্তরীণ পরজীবী প্রতিরোধের জন্য অ্যান্থেলমিন্টিক ওষুধ ব্যবহার করতে হবে।

কবুতর পালনের সুবিধা

* শহুরে এবং গ্রামীণ উভয় ক্ষেত্রেই ছোট পরিসরে এবং স্বল্প পুঁজির কবুতর পালন গৃহস্থালির কাজের পাশাপাশি করুতর পালন করা যায়।
* এই ব্যবসায় তুলনামূলকভাবে কম পরিশ্রমে এবং অল্প সময়ের মধ্যে লাভ পাওয়া যায়।
* নারী পুরুষ সকলেই চাই কবুতল পালন করতে পারে।
* কবুতর বিক্রি করতে বেগ পেতে হয় না। নির্দিষ্ট কবুতরের দাম বেশি পাওয়া যায় বলে লাভের সম্ভাবনা অনেক বেড়ে যায়।

কবুতর পালনের অসুবিধা

* সঠিক সময়ে রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসা করতে না পারলে মৃত্যুর সংখ্যা বাড়তে পারে।
* সঠিক সময়ে বিক্রি করতে না পারলে উৎপাদন খরচ বেড়ে যায় ফলে লসের সম্ভাবনা থাকে।

উপসংহার

কবুতর পালন আমাদের দেশে সখের বসত বেশি পালন করা হলেও এর থেকে আয় করে থাকেন অনেকেই। কেননা কবুতরের সংখ্যা বৃদ্ধি হলে আয়ের চাহিদা বেড়ে যায়। আশা করি সঠিক কবুতর পালন প্রকৃয়া নিয়ে বিস্তারিত ধারনা আপনাদের দিতে পেরেছি।

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url